"জাতীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ দিবসের প্রাক্কালে কলকাতার বিশিষ্ট চিকিৎসকগণ জারি করলেন জরুরি স্বাস্থ্য বিধি"



ওয়েব ডেস্ক; কলকাতা, ২ ডিসেম্বর : জাতীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ দিবসের প্রাক্কালে অ্যাসোসিয়েশন অফ চেস্ট ফিজিশিয়ান ওয়েস্ট বেঙ্গল , সাউথ এশিয়ান মেডিকেল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন এন্ড সোসাইটি অফ ইমার্জেন্সি মেডিসিন অফ ইন্ডিয়া, ওয়েস্ট বেঙ্গল চ্যাপ্টার এন্ড ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম - এর সহযোগিতায় সুইচঅন ফাউন্ডেশন দ্বারা আয়োজিত একটি সাংবাদিক সম্মেলনে, বিশিষ্ট চিকিৎসকগণ জনস্বাস্থ্যের উপর বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কিত ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয়টি মাথায় রেখে একটি অতি জরুরি স্বাস্থ্যবিধি প্রকাশ করলেন। শীতকালীন দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা জন্য দৈনন্দিন জীবনে গৃহীত আচরণবিধি ছাড়াও এই স্বাস্থ্য উপদেষ্টাটিতে এমন অনেক অনুশীলন-এর কথা বলা হয়েছে যা প্রয়োগ করলে সরকার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলির পাশাপাশি প্রত্যেক শহরবাসী বায়ু দূষণের প্রভাব প্রতিরোধ করতে পারবে।

বায়ুর গুণমান হ্রাসের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। জনসাধারণকে এর প্রকোপ থেকে সুরক্ষিত রাখার তাগিদে চিকিৎসকেরা সচেতনতা এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থার জরুরি প্রয়োজনের উপর জোর দিয়েছেন। সিএমআরআই হাসপাতালের ডাঃ অরূপ হালদার, আইপিজিএমইএন্ডআর এন্ড এসএসকেএম হাসপাতালের ডাঃ সৈরিন্ধ্রি ব্যানার্জী, এনএইচ নারায়ণা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের ডাঃ সুমন মল্লিক এবং ফর্টিস হাসপাতালের ডাঃ সংযুক্তা দত্তের মতো কলকাতার বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট চিকিৎসক এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

সুইচঅন ফাউন্ডেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর শ্রী বিনয় জাজু বলেছেন, “স্বাস্থ্য আধিকারিক এবং চিকিৎসকদের মতে, বায়ুদূষণ স্বাস্থ্যের জন্য এক সঙ্কটকালীন পরিস্থিতি তৈরী করেছে। এই স্বাস্থ্য উপদেষ্টাটিতে বায়ু দূষণের কারণে সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান সমস্যাগুলির মোকাবিলায় জনসাধারণ এবং নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে।" তিনি আরও বলেন , "আমাদের সমীক্ষা অনুযায়ী ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এর কাছে বায়ুর গুণমান সূচক উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বিগত তিন বছরে, কলকাতার ফুসফুস হিসাবে পরিচিত ভিক্টোরিয়া এবং ময়দান কলকাতার সবচেয়ে দূষিত স্থান হিসাবে উঠে এসেছে ।”

ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকার হেলথ এফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশনের গ্লোবাল বার্ডেন অফ ডিজিজ প্রজেক্টের দ্য এয়ার কোয়ালিটি অ্যান্ড হেলথ ইন সিটিস রিপোর্ট অনুসারে, কলকাতা বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত শহর হিসাবে বায়ুদূষণের অনভিপ্রেত পরিণাম ভোগ করছে । কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এবং পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন থেকে এই তথ্য সামনে এসেছে যে বায়ুর গুণমানের এই ক্রমাগত অবনতি এবং জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের উপর এর বিরূপ প্রভাব জরুরিভিত্তিক সমাধানমূলক পদক্ষেপের দাবি রাখে। 

সিএমআরআই হাসপাতালের কনসালটেন্ট পালমোনোলজিস্ট ড: অরূপ হালদার প্রেস কনফারেন্সে বক্তব্য রেখেছেন, “পৃথিবী জুড়ে ক্রমবর্ধমান রোগব্যাধির এই প্রেক্ষাপটে বায়ু দূষণই হল মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ যার ফলে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ৯০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারান। শুধুমাত্র সচেতনতার দ্বারাই বায়ু দূষণের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ লড়া যেতে পারে। জাতীয় বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ দিবসে, আমরা প্রত্যেককে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হতে এবং শ্বাসযন্ত্রের যত্ন নিতে আহ্বান জানাই।”

আইপিজিএমইএন্ডআর এবং এসএসকেএম হাসপাতালের রেডিয়েশন অঙ্কোলজি বিভাগের সিনিয়র রেসিডেন্ট, ডাঃ সৈরিন্ধ্রি ব্যানার্জী বলেন, “আমি দেখেছি, বায়ুদূষণে দীর্ঘক্ষণ ধরে থাকা এবং নির্দিষ্ট কয়েক ধরণের ক্যান্সারের ঝুঁকির মধ্যে একটি সম্পর্ক রয়েছে যা রীতিমত উদ্বেগজনক। দূষিত বাতাসের বিষাক্ত উপাদানগুলি জীবকোষে পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। এই পরিবেশগত ঝুঁকির কারণেই জনস্বাস্থ্য বিধি জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।"

বায়ু দূষণের ফলে কোনো ব্যক্তির স্বাস্থ্যের কতটা অবনতি হতে পারে তা নির্ভর করে দূষণের মাত্রা কতটা এবং সেই ব্যক্তি দূষিত স্থানে কতক্ষণ ধরে রয়েছেন তার উপর। ডেমোগ্রাফিক ফ্যাক্টর এবং ব্যক্তির বর্তমান স্বাস্থ্য অবস্থাও নির্ধারণ করে বায়ুদূষণের ফলে তিনি কতটা আক্রান্ত হতে পারেন। 

এই সাংবাদিক সম্মেলনে কলকাতার "স্টেট অফ এয়ার কোয়ালিটি রিপোর্ট ২০২৩" প্রকাশ করা হয়। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে যে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ও সংলগ্ন এলাকায়, বায়ুর গুণমান খুবই উদ্বেগজনক। ডিসেম্বর ২০২১ এবং ডিসেম্বর ২০২২ এর মধ্যে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (এ কিউ আই) ৭০% বৃদ্ধি পেয়েছে।গত তিন বছরের এ কিউ আই রেকর্ড অনুসারে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বায়ু দূষণের আকস্মিক বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আশ্চর্যজনক ভাবে এটি লক্ষ্য করা গেছে, পূর্বে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ছিল কলকাতার সবচেয়ে দূষিত অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি যেখানে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে এ কিউ আই-এর মান রেকর্ড করা হয়েছিল ৩৪৪ যেটি ডিসেম্বর ২০২২-এর শীতকালীন সময়ে ২৯৬ তে নেমেছে এবং ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে, এই বায়ুর গুণমান ২০২১-এর জানুয়ারী থেকে ৩৪% কমেছে। উদ্বেগজনক ভাবে লক্ষ্য করা গেছে যে বর্ষার সময়ে বায়ুর গুণমানের স্বাভাবিক উন্নতি সত্ত্বেও, ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ভিক্টোরিয়া ও সংলগ্ন অঞ্চলে এ কিউ আই জুন মাসে ৩৪% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আগস্টে ২২% বৃদ্ধি পেয়েছে। এটিও দেখা গেছে যে রাতের তুলনায় সকালের দিকে বাতাস বেশি দূষিত হয়।
 

এনএইচ নারায়না সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের রেডিয়েশন অংকোলজি বিভাগের চিফ এবং ক্লিনিক্যাল ডিরেক্টর ডাঃ সুমন মল্লিক বলেন, “ পশ্চিমবঙ্গ এবং কলকাতার ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সার এর প্রবণতা সবচেয়ে বেশি এবং কয়েক বছর ধরে এর বৃদ্ধি রীতিমত উদ্বেগজনক ( ২০০৬-০৭ এ ১৪.৯% থেকে ২০২০ তে ২০% )। এবং এই ধরণের ক্যান্সার মহিলাদের এবং অধূমপায়ীদের মধ্যে এখন বেশি দেখা যাচ্ছে। যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া এবং অনুপযুক্ত উপায়ে বর্জ্য নিষ্পত্তির কারণে বায়ুতে অতি সূক্ষ্ম কণা (বিশেষত PM 2.5)-র পরিমাণ বাড়ছে। এই কণা এপিথেলিয়াল টিস্যুর সংখ্যা এবং আকার বৃদ্ধির জন্য দায়ী এবং এর ফলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে । "

সোসাইটি ফর ইমার্জেন্সি মেডিসিন, ইন্ডিয়া, ওয়েস্ট বেঙ্গল চ্যাপ্টার-এর প্রাক্তন সভাপতি এবং কলকাতা ফর্টিস হাসপাতালের ইমার্জেন্সি মেডিসিন বিভাগের কন্সাল্ট্যান্ট এবং মুখ্য আধিকারিক ডঃ সংযুক্তা দত্ত বলেছেন, “বায়ু দূষণ স্বাস্থ্যের পক্ষে একটি প্রধান পরিবেশগত বিপদসংকেত । এটি ফুসফুস, মস্তিষ্ক, কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমের মতো আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলির ক্ষতি করে। শুধু তাই নয়, এটি আমাদের আয়ু উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) দ্বারা প্রকাশিত সাম্প্রতিক তথ্যগুলিতে দেখা গেছে যে বায়ু দূষণ শিশু স্বাস্থ্য এবং শিশুদের আয়ুর উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।"

Post a Comment

0 Comments