আসানসোলের প্রবীণ রোগীর শরীরে পূর্ব ভারতের প্রথম দেশীয় MyCLIP TEER প্রতিস্থাপন করল মণিপাল হাসপাতাল




কলকাতা, ১৭ ডিসেম্বর : মণিপাল হাসপাতাল, ইএম বাইপাস—উন্নত হৃদরোগ চিকিৎসায় একটি ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করেছে। ২০২৫ সালের ২৯ নভেম্বর আসানসোলের বাসিন্দা ৬০ বছর বয়সী রামস্বারূপের শরীরে সফলভাবে পূর্ব ভারতের প্রথম MyCLIP TEER প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। 

এই গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেন ডা. দিলীপ কুমার, ডিরেক্টর ক্যাথ ল্যাব, সিনিয়র ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট এবং ডিভাইস ও স্ট্রাকচারাল হার্ট বিশেষজ্ঞ, মণিপাল হাসপাতাল, ইএম বাইপাস। প্রচলিত ওপেন-হার্ট সার্জারির জন্য যিনি অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকির রোগী ছিলেন, তাঁর জন্য এই পদ্ধতি একটি নিরাপদ ও কার্যকর চিকিৎসার পথ খুলে দেয়। ডা. দিলীপ কুমারের সঙ্গে এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ডা. প্রকাশ কুমার হাজরা, ডিরেক্টর ও হেড অব কার্ডিওলজি, মণিপাল হাসপাতাল, ঢাকুরিয়া; ডা. রবিন চক্রবর্তী, সিনিয়র কনসালট্যান্ট – কার্ডিওলজি, মণিপাল হাসপাতাল, ইএম বাইপাস; এবং ডা. অনিল কুমার সিংঘি, সিনিয়র কনসালট্যান্ট – পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি, মণিপাল হাসপাতাল, ইএম বাইপাস। এই সাফল্য বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসকদের সম্মিলিত দলগত সহযোগিতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

এই ঐতিহাসিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত MyCLIP যন্ত্রটি আগে বিশ্বজুড়ে মাত্র দুটি সংস্থা তৈরি করত, যার ফলে পুরো চিকিৎসার খরচ প্রায় ৩০ লক্ষ টাকার কাছাকাছি ছিল। তবে ভারতের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগের অধীনে এখন এই যন্ত্রটি ভারতেই মেরিল সংস্থা তৈরি করছে, যার ফলে খরচ প্রায় ৫০ শতাংশ কমে প্রায় ১৫ লক্ষ টাকায় নেমে এসেছে। রামস্বারূপ আসানসোলের একজন ছোট ব্যবসায়ী এবং তাঁর কোনও সরকারি স্বাস্থ্যবিমা ছিল না। আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে এই চিকিৎসা তাঁর পক্ষে করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। বিষয়টি বিবেচনা করে ডিভাইস প্রস্তুতকারী সংস্থা তাদের কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা উদ্যোগের অংশ হিসেবে যন্ত্রটির খরচ আরও ৫০ শতাংশের বেশি কমিয়ে দেয়। পাশাপাশি মণিপাল ফাউন্ডেশন ও আরও একটি সামাজিক সংস্থার সহায়তায় নিশ্চিত করা হয় যে রোগীর উপর কোনও অতিরিক্ত আর্থিক চাপ না পড়ে।

মাইট্রাল রিগারজিটেশন তখন হয়, যখন হৃদযন্ত্রের একটি কপাট ঠিকমতো বন্ধ হতে পারে না এবং রক্ত সামনের দিকে যাওয়ার বদলে উল্টো দিকে ফিরে আসে। এর ফলে হৃদযন্ত্রকে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। শ্বাসকষ্ট, অতিরিক্ত ক্লান্তি, ঘুমের সমস্যা এবং সব সময় দম বন্ধ হয়ে আসার অনুভূতি—এইসব উপসর্গে ভুগছিলেন রামস্বারূপ। তিনি ডাইলেটেড কার্ডিওমায়োপ্যাথি-তে আক্রান্ত ছিলেন, যেখানে হৃদযন্ত্র বড় ও দুর্বল হয়ে যায় এবং রক্ত পাম্প করার ক্ষমতা কমে যায়। তাঁর LVEF ছিল মাত্র ২৫ শতাংশ, অর্থাৎ হৃদযন্ত্র স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম রক্ত পাম্প করছিল। এর সঙ্গে ছিল গুরুতর মাইট্রাল রিগারজিটেশন, পালমোনারি হাইপারটেনশন (ফুসফুসের রক্তনালিতে উচ্চ রক্তচাপ), সামান্য করোনারি আর্টারি ডিজিজ (CAD) এবং উচ্চ রক্তচাপ। এর আগে তিনি গুরুতর অ্যানাসার্কা (সারা শরীরে অতিরিক্ত জল জমে যাওয়া) ও হার্ট ফেইলিওর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল হওয়ায় ওপেন-হার্ট সার্জারি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাই MyCLIP TEER প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এই ধরনের উচ্চ ঝুঁকির রোগীদের জন্য MyCLIP TEER সিস্টেম, একটি মেইড-ইন-ইন্ডিয়া উদ্ভাবন, একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প। এই পদ্ধতিতে হৃদযন্ত্রের কপাটের পাতাগুলোকে নিখুঁতভাবে কাছাকাছি এনে রক্তের উল্টো প্রবাহ বন্ধ করা হয় এবং হৃদযন্ত্রের কাজের দক্ষতা বাড়ানো হয়।

রামস্বারূপের ক্ষেত্রে MyCLIP (LW-12/6) চিকিৎসা যন্ত্রটি সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়, যার ফলে গুরুতর কপাটের লিকেজ প্রায় সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে আসে। এর প্রভাব প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেখা যায়—শ্বাস নিতে আর কষ্ট হচ্ছিল না, বুকের চাপ কমে যায়, ঘুম ভালো হয় এবং সামগ্রিকভাবে তাঁর শারীরিক অবস্থার স্পষ্ট উন্নতি হয়। মাত্র দু’দিনের মধ্যেই তিনি স্থিতিশীল অবস্থায় হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান এবং আবার নিজের ব্যবসার কাজে ফিরে যান। এই সাফল্য শুধু পূর্ব ভারতের জন্য একটি বড় চিকিৎসা সাফল্য নয়, বরং দেশীয় চিকিৎসা প্রযুক্তি কীভাবে একসময় চিকিৎসার বাইরে থাকা রোগীদের জন্য জীবনরক্ষাকারী সমাধান এনে দিতে পারে, তারও একটি শক্তিশালী দৃষ্টান্ত।

Post a Comment

0 Comments